মঙ্গলবার ,২১শে অগাস্ট,২০০৭
দুপুর ১২টাঃ
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কাল । পুলিশের সাথে ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টদের ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে । সাথে যোগ দিয়েছে বুয়েট,ঢাকা মেডিক্যাল সহ আর অনেক প্রতিষ্ঠানের ছাত্র । আমি তখন সবে মাত্র ঢাকা সিটি কলেজে ভর্তি হয়েছি । বড় ভাইয়ের সাথে বুয়েটের হলে থাকি। শেরে বাংলা হল, রুম নাম্বার ৪০১১। একটা সিটেই তখন ২জন কষ্ট করে থাকি। বড় ভাই তার থিসিসের কাজে সেদিন কিশোরগঞ্জ গেছে।হলের বারান্দা থেকে দেখলাম রাস্তায় অনেক মানুষ,সবাই খুব বেস্ত হয়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে । এইসব দেখে আমি পলাশীর মোড়ে আসলাম। এসে দেখি ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা টায়ারে আগুন ধরিয়ে রাস্তা ব্লক করে রেখেছে। আর সবাই একসাথে হয়ে শ্লোগান দিচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর। আমার মধ্যে একধরনের এক্সাইটমেন্ট কাজ করতে লাগল। আগে কখনও এইরকম সামনাসামনি মিটিং মিছিল আন্দোলন দেখিনি ,টিভি,খবরের কাগজে পরতাম শুধু। একজন ফোনে বলতেছে ঢাকা মেডিক্যালের রাস্তা ব্লক করে রাখ আমরা পলাশী ব্লক করে রাখছি। আমার মতো উৎসুক জনতারও অনেক ভিড় ছিল।
বিকাল ৪টাঃ
হলের সবাই ছুটাছুটি করা শুরু করলো।হলের নোটিশ বোর্ডের কাছে ভিড় জমাতে লাগল সবাই। শূনতে পেলাম সরকার মাত্র ঘোষণা দিয়েছে হল ভেকেন্ট করে দেওয়ার জন্য। আগামি ২ঘণ্টার মধ্যে হল ভেকেন্ট না হলে সেনাবাহিনী এসে সার্চ করবে, কাউকে পেলেই ধরে নিয়ে যাবে। আর সন্ধ্যা থেকে সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে। রাস্তায় ৩জনের বেশী দেখলেই ধরে নিয়ে যাবে। আমি বুঝতেছিলাম না কি করবো। সবাই যে যার মতো খুব দ্রুত ব্যাগ নিয়ে হল থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। আমি রুমে চলে গেলাম।গিয়ে দেখি ভাইয়ের রুমমেটরা সবাই চলে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে । সবাই আমাকে খুব আদর করত । নিজের ছোট ভাইয়ের মতো দেখত । পড়ালেখা থেকে শুরু করে যে কোন সমস্যা হলে কেউ না কেউ এগিয়ে আসত। আমাকে মেহরাব ভাই বলল তোর ভাইতো আজকে আসবেনা।আর তোর ভাইকে মোবাইলেও পাবিনা ,সব মোবাইলের নেটওয়ার্ক অফ করে দিছে সরকার। এক কাজ কর তুই কামালের বাসা চিনিস? কামাল আমার ভাইয়ের বন্ধু এবং আমাদের গ্রামের বড় ভাই, তারা আজিমপুরে থাকে। আমি বেশ কয়েকবার বড় ভাইয়ের সাথে তাদের বাসায় গিয়েছি । তাই মেহরাব ভাই আমাকে বলল তুই আজিমপুরে ওদের বাসায় চলে যা, যদি লাগে বল আমি তোকে দিয়ে আসি । আমি বললাম না আমি পারব। আমি দ্রুত একটা ব্যাগ গুছায়ে বের হয়ে পরি । রাস্তায় নেমে দেখি ভয়াবহ অবস্থা । কোন রিক্সা খালি নেই । এক ছেলে সাথে তার গার্ল ফ্রেন্ড খুব সম্ভবত ,রিক্সাওালাকে বলতেছে মামা আজিমপুর যাবেন । রিকশাওয়ালা সেই ভাব নিয়ে আছে । না মামা যাবনা । ঐ ছেলে রিকশাওয়ালাকে প্রথমে ধমক দিয়ে বলল যাবেন না কেন। পরে খুব নরম সূরে বলতেছে মামা প্লিজ চলেন । পারলে সে রিক্সাওয়ালার পায়ে ধরে বসে থাকে তাও রিকশাওয়ালা যাবেনা । আমি আর চেষ্টা না করেই হেটে রওয়ানা দিলাম। হাটতে হাটতে প্রায় ৩০ মিনিট পর কামাল ভাইয়ের বাসায় পৌঁছলাম। কিন্তু গিয়ে দেখি তাদের রুমে তালা দেওয়া । সম্ভবত তারা গ্রামের বাড়িতে গেছে। মোবাইল বের করে ফোন দিব তাও পারছিনা, নেটওয়ার্ক নেই। খুব চিন্তিত মনে হলে আসলাম। ইতিমধ্যে ২/১ জন ছাড়া সবাই চলে গেছে। আমি রুমে চলে যাই। অল্প কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যা নেমে আসে। রুমে বসে বসে গান শুনছিলাম। হটাত করেই ইলেক্ট্রিসিটি চলে যায়। হলে ইলেক্ট্রিসিটি যায়না কোনসময় । পরে বুঝতে পারলাম হলের সব ইলেক্ট্রিসিটির লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
রাত ৯টা :
আমি অন্ধকার রুমে বসে আছি । খুব খিদে পেয়েছে কিন্তু নিচেও নামতে পারছিনা । হলের সব গেইট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একটু পর পর সেনাবাহিনীর গাড়ি টহল দিচ্ছে সাইরেন বাজিয়ে। বারান্দায় বসে ছিলাম, ভয়ে রুমে চলে যাই।আমি ছোট বেলা থেকেই ভুত অনেক ভয় পেতাম , অন্ধকারে রাস্তায় বেরুতে ভয় লাগত। সেদিন আমি সম্পূর্ণ হলে একা , কোথাও কেউ নেই , নেই সামান্য আলো। সবগুলা রুম তালাবদ্ধ।মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই তাও অনেকবার ট্রাই করছিলাম যদি কারো মোবাইলে কল যায়। সেদিন আমার ভুতের ভয় পাওয়ার কথা ছিল সবচেয়ে বেশী কিন্তু অবিশ্বাস্য কোন কারনে আমার ওইধরনের কোন ভয় কাজ করেনি। যদি সেনাবাহিনী এসে রুমে তালাস করে যদি আমাকে ধরে নিয়ে যায়,এইটা ভেবেই খুব ভয় পাচ্ছিলাম । দেহ কোষের হাইপোথ্যালামাস ব্রেইনকে বার বার পাকস্থলী শুন্যতার সিগন্যাল পাঠাচ্ছে । ভয় , খিদে ২টা একসাথে । মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রচণ্ড খিদে লাগার কারনে ভয়টা কম কাজ করতেছিল । মস্তিষ্কে ভয়ের সিগন্যালের চেয়ে খিদের সিগন্যাল বেশী প্রাধান্য পাচ্ছিল। রুমের ভিতরে অনেক গরম তাই বারান্দায় একটু সাহস করে আসি। বারান্দায় বসে বসে দেখছিলাম কিছুক্ষণ পর পর গাড়ি ভর্তি আর্মি আসছে আর এদিক ওদিক যাচ্ছে। আমি অন্ধকারে বসে শুধু তাকিয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণ পর রুমে যাই ঘুমানোর জন্য। মোবাইলটা হাতে নিতেই অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটল, দেখি ৫টা মিসকল । একটা সিটিসেল নাম্বার থেকে। তারপর আমি অনেকবার ট্রাই করি কিন্তু কোনভাবেই নেটওয়ার্ক পাইনি। সেই ভূতুরে কলের আর অনুসন্ধান পাইনি। অনেক কিছু চিন্তা করতে করতে একসময় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পরি।
__________________________
মোবাইলে ১৫টা মিসকল উঠে আছে। তন্দ্রা মেয়েটার এই একটা স্বভাব , মোবাইল না ধরলেও সে কল করতেই থাকে।
-এতক্ষণ লাগে ফোন ধরতে ?
-একটা গল্প লিখছিলাম ।
-তোমার খালি এইসব আজাইরা গল্প লেখা। কেউ পড়ে তোমার গল্প?
-আমিতো কারো পড়ার জন্য গল্প লেখিনা । নিজের জন্য লেখি । আর কেই না পড়ুক একজনতো পড়বে।
-গল্প লেখা শেষ ?
-শেষ অংশটা বাকি । অবশ্য এইটা লিখব কিনা বুঝতেছিনা ।
-বাদ দাও লিখার দরকার নাই ।
-কালকে সাথে করে নিয়ে এসো।
এই তন্দ্রা মেয়েটা অদ্ভুত। ছোটবেলায় প্রত্যেক প্রবন্ধের নামকরনের সার্থকতা লিখতে হত। তন্দ্রার নামকরন সম্পূর্ণভাবে সার্থক। ওর সাথে কথা বললেই আমার ঘুম আসে ।মনে হয় বিশাল এক গাছের ছায়ার নিচে আরামদায়ক কোন বেঞ্চেতে শুয়ে আছি । বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে আর পাশে সমুদ্রের গর্জন ।