সুইসাইড নোট

রাত ১১টা , সুইসাইডের জন্য উপযুক্ত সময়।
সুইসাইডের জন্য সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে ঘুমের ওষুধ। অ্যামেরিকায় প্রেসক্রিপশন ছাড়া কাউকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়না। কিন্তু বাংলাদেশে যে কেউ চাইলেই যত ইচ্ছা ঘুমের ওষুধ কিনতে পারে।সবার ধারনা গভীর ঘুমের মধ্যে মারা গেলে কোন কষ্ট হবেনা।এই জন্যই সবাই সুইসাইডের মাধ্যম হিসাবে ঘুমের ওষুধকেই বেছে নেয়।
সুইসাইডকে এক সময় ক্রাইম হিসাবে গণ্য করা হত।অনেক আগে একবার লন্ডনে হেনরি চার্চিল নামে ৬০বছরের এক বেক্তি গুলি করে সুইসাইড করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত আহত হয় । পরে তাকে ৬ মাসের জন্য জেলে পাঠানো হয় সুইসাইড এটাম্পট করার অপরাধে।
এই মুহূর্তে অবন্তির হাতে ১৬টা রেস্টরিল । এর আগেও সে কয়েকবার ট্রাই করেছে। কিন্তু সাহসের অভাবে পারেনি। এইবার ফাইনাল। সে মোটামুটি একটা রিসার্চ করে ফেলছে। ১৬টা রেস্টরিল খাওয়ার পর তার হাতে সময় থাকবে মোট ২৫ থেকে ৩০ মিনিট। সে কি কি করবে সব কিছুই অনেক আগে থেকেই প্ল্যান করা।
এখন ঘড়িতে ঠিক ১১টা বাজে। অবন্তি সবগুলো ওষুধ খওয়ার জন্য হাতে নিল । তার ভিতরটা কেমন ধুক ধুক করে উটল। হটাত বড় কোন ঘটনার সম্মুখীন হলে রক্তে এপিনেপ্রিন খুব বেশী পরিমাণে নিঃসৃত হতে থাকে এতে হার্টবিট এবং ব্লাড প্রেসার বেরে যায়। অবন্তির হাত কাঁপছে।কাঁপা কাঁপা হাতে সে সবগুলো ওষুধ খেয়ে নিল । বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে।অবন্তি প্রথমে ঘরের বাতি নিবিয়ে দিল। ঘরের মধ্যে শুধু সামান্য মোমবাতির আলো। হাতে মাত্র ২৫মিনিট সময়। সে প্রথমেই নাতাসা বেডিংফিল্ডের পকেট ফুল অফ সান্সাইন গানটা ছাড়ল । ঠিক তার পরে শুনবে এডেলের সামওয়ান লাইক ইউ এবং সবশেষে জন ডেনেভারের কান্ট্রি রোড । আগে থেকেই তার সবচেয়ে পছন্দের গানগুলো ঠিক করে রেখেছিল। পকেট ফুল অফ সান্সাইন গানটি বেজে চলছে।
Take me away
A secret place
A sweet escape …
অবন্তি জানালার পাশে বসে বৃষ্টি দেখছে আর গান শুনছে । জীবনের শেষ বৃষ্টি,শেষ মুহূর্ত ভাবতেই কেমন জানি লাগছে। তবে এখন অবন্তিকে অনেক স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। দেখে কেউ বুঝতেও পারবেনা একটু আগেই সে ১৬টি ঘুমের ওষুধ খেয়েছে। একটা মানুষের মৃত্যু মিনিমাম ৬জনকে তীব্রভাবে এফেক্ট করে । অবন্তি চিন্তা করছে এই ৬জন কে কে হতে পারে। তার বাবা, মা। বাবা থাকেন অ্যামেরিকা আর মা লন্ডন। ৩য় জন তার ফুফি ।অবন্তি তার ফুফির সাথেই থাকে। ৩ জন পাওয়া গেছে। আর একজনের ব্যাপারে সে নিশ্চিত নয়। অমিত , অবন্তির ফুপির বাসায় ভাড়া থাকে । অবন্তি অমিতকে খুব পছন্দ করে কিন্তু সেটা অমিতকে কোনভাবেই বলতে পারেনা । অবন্তি খুব ইন্ট্রোভার্ট মেয়ে। অবন্তি এইসব চিন্তা বাদ দিয়ে এখন সে শেষ মুহূর্তগুলোকে এঞ্জয় করার চেষ্টা করছে। বৃষ্টির শব্দের সাথে সাথে কান্ট্রি রোড গানটা শুনতে অসম্ভব ভাল লাগছে,নতুন এক ধরনের ছন্দ তৈরি হয়েছে। গানটি শেষ হলেই অমিতের জন্য একটা চিরকুট লিখতে হবে।
রাত ২টা। অবন্তিকে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে নেওয়া হল । অমিতের হাত পা কাঁপছে। সে কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছেনা ।ঐ হাস্পাতালের ডিউটি ডাক্তার জানায় বেসরকারি কোন হাসপাতালে পয়জনের রুগিকে ওয়াশ করানো হয়না। অবন্তির মুখে অক্সিজেন লাগানো আছে। অমিত আর অবন্তির ফুফি এম্বুলেন্সে করে অবন্তিকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যালে খুব দ্রুত চলে গেল।একটা ট্রলিতে অবন্তিকে শুইয়ে রাখা হল। অমিত দ্রুত একটা টিকেট আনতে গেল ।তার সাথে হাসপাতালের একজন ওয়ার্ড বয় ।টিকেট কাউন্টারের লোক বসে বসে ঝিমাচ্ছিল। প্রথমে অমিতকে দেখে সে খুব বিরক্ত হল । পরে সে রুগীর নাম জিজ্ঞাসা করল । অমিত হাপাতে হাপাতে বলল ভাই একটু তারাতারি করেন । কাউন্টারের লোক তার কথায় কোন পাত্তা দিল বলে মনে হল না। পরে তাকে রুগীর বয়স, ঠিকানা ,রুগী তার সম্পর্কে কি হয় ইত্যাদি জিজ্ঞাস করল।অমিতের ইচ্ছে করছে বলতে , রুগী মারা যাচ্ছে এইদিকে এখন এইসব লেখার কি কোন দরকার আছে । কিন্তু সে বলতে পারেনি। ওয়ার্ড বয় বলল টিকেট নিয়ে ১১৫ নাম্বার রুমে চলে যান, ওইখানে ডাক্তারের কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন লিখে নিয়ে আসেন। ডাক্তারের বয়স খুব অল্প । হেরিসনের ইন্টারনাল মেডিসিনের মোটা বইটি পড়তে পড়তে টেবিলে ঘুমিয়ে পরেছে। ঘুম থেকে উঠে সে চোখে মুখে পানি দিয়ে আসল । ডাক্তার অমিতকে জিজ্ঞাসা করল কতক্ষন হয়েছে আর কি ওষুধ খেয়েছে। অমিত কিছুই বলতে পারেনি।পরে জিজ্ঞাসা করল রুগী আপনার কি হয়। অমিত বলল আমার পরিচিত। ডাক্তার খুব বিরক্ত হয়ে আর কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। প্রেসক্রিপশন পাওয়ার পর ২জন লোক অবন্তিকে ১২৭ নাম্বার রুমে নিয়ে গেল। অমিতও সাথে সাথে গেল। রুমের ভিতরে একটা বড় ড্রাম আর কয়েকটি পাইপ ছাড়া আর কিছুই নেই। রুমটা দেখতে অনেকটা গ্যারেজের মতো লাগছে। অবন্তি তখনও মাঝে মাঝে একটু নড়তেছিল। একজন এসে একটা দড়ি দিয়ে অবন্তির পা দুটা বেঁধে দিল আর হাত ২টা আলাদা আলাদা করে ট্রলির সাথে বেঁধে দিল। লবন পানি দিয়ে কিছুক্ষণ পাকস্থলী খালি করার চেষ্টা করা হল।অবন্তি তার অবচেতন মনেই সমস্ত শক্তি দিয়ে হাত পা ছোড়াছুড়ি করার চেষ্টা করছে ঠিক যেভাবে কোরবানির সময় একটা পশু ছটফট করে। ওয়াশ শেষে ঐ ২লোক ৫০০টাকা করে চাচ্ছে। অমিতের হাতে এত টাকা নেই । কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। শেষে ওয়ার্ড বয় বলল আমি দিয়ে দিচ্ছি আপনি আমাকে পরে খুশি করে দিয়েন। সেখান থেকে অবন্তিকে নিয়ে যাওয়া হল ৭তলায়।৭তলায় ২টা ওয়ার্ড, ওয়ার্ড-এ আর ওয়ার্ড-বি। কোন ওয়ার্ডেই সিট ফাকা নেই। বারান্দাও ভর্তি রুগীতে ।২ ওয়ার্ডের মাঝামাঝি বারান্দার এক কোনে সেই ওয়ার্ড বয়টি জায়গা মেনেজ করে দিল। ভর্তি করার সময় ৭তলা থেকে প্রেসক্রিপশনের ডান পাশে পুলিশ কেইস লেখা বড় একটা সিল মেরে দিল। নার্স এসে কয়েকটা চারকল নিউট্রলাইজার ইনজেকশন দিল যাতে ড্রাগ খুব দ্রুত নিউট্রলাইজ হতে পারে । আর একটা ইন্টাভেনাস ফ্লুয়িড সেলাইন দিয়ে রাখল। বলে গেল এই সেলাইন শেষ হলে যেন ওয়ার্ডে গিয়ে জানিয়ে আসে।অবন্তির ফুফি পাশে বসে বসে কাঁদছে আর অমিত তাকিয়ে আছে অবন্তির দিকে। কি এমন কারন যার কারনে সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চায় মেয়েটি। একবার অবন্তি একটা নুড়ি পাথর দিয়ে বলেছিল জানেন একটা ছেলে পেঙ্গুইন যখন আরেকটা মেয়ে পেঙ্গুইনকে পছন্দ করে তখন আসেপাশের সবচেয়ে সুন্দর নুড়ি পাথরটা সেই মেয়ে পেঙ্গুইনের জন্য খুঁজে নিয়ে আসে।অমিত তখন শুধু বলেছিল বাহ তুমিতো অনেক কিছু জান দেখছি।
ওয়ার্ড বয় অমিত কে বলল ভাই আমাকে বিদায় দিয়ে দেন। অমিত কি করবে বুঝতে পারছেনা। তার হাতে এই মুহূর্তে কোন টাকা পয়সা নেই। তন্দ্রাকে ফোন করতে হবে । তাকে বললেই সে টাকা নিয়ে হাজির হবে।
-হ্যালো তন্দ্রা
-হুম বল
– তুমি কিছু টাকা নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল চলে আস। (তন্দ্রা খুব বিস্ময়ের এবং আতঙ্কের সাথে অনেকগুলা প্রশ্ন করা শুরু করল )
– কার কি হয়েছে ? তুমি কোথায় ?কি হয়েছে ? (মেয়েটি অল্পতেই অস্থির হয়ে যায় )
– সব পরে বলবো , তুমি আস । আর, চিন্তার কিছু নেই আমার কিছু হয়নি।
একটা স্যালাইন শেষ হয়ে গেছে। ওয়ার্ডে গিয়ে দেখল আগে যারা ডিউটিতে ছিল তারা নেই।সবাই নতুন, সেকেন্ড শিফট শুরু হয়েছে। কাগজ দেখিয়ে অমিত বলল এই পেশেন্টের স্যালাইন শেষ হয়ে গেছে আরেকটা স্যালাইন লাগবে। ওরা কিছুক্ষণ কাগজ দেখে বলল এই রুগীতো আমাদের ওয়ার্ডের না।সে অবাক হয়ে বলল ভর্তিতো এইখান থেকেই করা হয়েছে। ঐ লোক তখন বলল এইখানে ৭১২ লেখা ওইটা পাশের বি-ওয়ার্ডের আন্ডারে। বি- ওয়ার্ডের ওরা বলল চিকিৎসাতো এ-ওয়ার্ডের আমারা আবার কিভাবে শুরু করবো, ওদের গিয়ে বলেন। অমিত কি করবে বুঝতে পারছিলনা । বি- ওয়ার্ডের সামনে বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়েছিল আর তখনি তন্দ্রাকে দেখেই একটু সস্থি পেল। তন্দ্রা কিভাবে কিভাবে যেন সবকিছু ঠাণ্ডা মাথায় ঠিক করে ফেলে। রূপবতী মেয়েদের সব কাজেই তাদের রুপের একটা ছোঁয়া থাকে। আধা ঘণ্টার মধ্যে তন্দ্রা সবকিছু মেনেজ করে ফেলল। অবন্তির শরীরে ধীর গতিতে স্যালাইন চলতে লাগলো। ডাক্তার এসে বলে গেলেন সকাল না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছেনা , সি ইস ইন ডেঞ্জার নাউ।
অমিত আর তন্দ্রা কিছুক্ষনের জন্য বাইরে বের হল । সমস্ত শহর ডুবে আছে অন্ধকারে। কালবৈশাখী লন্ডবন্ড করে দিয়ে গেছে সব। শহরটাকে গহীন অরণ্যের মতো মনে হচ্ছে। তন্দ্রা অমিতের হাত খুব শক্ত করে ধরে আছে। মাঝে মাঝে হালকা বাতাস এসে তন্দ্রার চুল এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে । ঝড়-তুফানের ঠিক পরের সময়টা হচ্ছে পবিত্র সময় । প্রকৃতি খুব শান্ত এবং পবিত্র থাকে । এই পবিত্র সময়ে হয়তো কোথাও কোন অমিত-তন্দ্রা হেটে চলছে ঘুমন্ত নগরীর ফাঁকা রাজপথে , হয়তো কোথাও কোন অবন্তি লিখে চলেছে তার সুইসাইড নোট।

Leave a comment